ভিজিট করুন নতুন ও স্হায়ী ব্লগ www.alomoy.com, it.alomoy.com

আলেমদের সমালোচনা: প্রসঙ্গ মাওলানা মওদুদী

১। ইসলামে সমালোচনার বিধান: ইসলামে গঠনমূলক সমালোচনা বা ইহতিসাবকে অবশ্যই উৎসাহ দেওয়া হয়। কারণ কোন মানুষেরই একার পক্ষে সকল দিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।আমরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে পড়ার মাধ্যমে ইমাম ভুল করে ফেললে শুধরে দেবার মাধ্যমে অন্যান্য প্রশিক্ষণের সাথে সাথে এটাও শিখি যে বাস্তব জীবনেও কেউ ভুল করে থাকলে সেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুধরে দিতে হবে। 

এজন্যই হযরত আবু বকর রা. খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে বলেছিলেন- “আপনারা যদি চান আমার আচরণ রাসুল সা. এর মত হোক তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবী। ভুল ত্রুটি থেকে তিনি ছিলেন পবিত্র। তাঁর মত আমার কোন বিশেষ মর্যাদা নেই।……আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি তাহলে সহায়তা করবেন আর যদি দেখেন বিপথগামী হচ্ছি তাহলে সতর্ক করে দেবেন” 
তবে অন্যতম শর্ত হচ্ছে যে ব্যাপারে সমালেচনা হচ্ছে আগে সেই ঘটনার বিস্তারিত প্রসঙ্গ ও পটভূমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাইবাছাই করতে হবে। 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِي 
“মুমিনগণ ,তোমাদের কাছে যখন কোন পাপাচারী কোন সংবাদ নিয়ে আসবে তখন তা যাচাই করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও” -(সুরা হুজুরাত ৪৯:৬) 

২। সমালোচনার নামে মিথ্যারোপের বিধান: 
সুরা ফুরকানের ৬৩ নং আয়াতে রহমানের বান্দাদের গুণাবলী বর্ণনা শুরু করে ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে- 
وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ‌ وَإِذَا مَرُّ‌وا بِاللَّغْوِ مَرُّ‌وا كِرَ‌امًا 
”এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়। ”(সুরা ফুরকান, ২৫:৭২) 
রাসুল সা. বলেছেন-“আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে অভিহিত করবনা? তা হল আল্লাহর সাথে শিরক করা, মাতাপিতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা।” (বুখারী) 

৩।মাওলানা মওদুদীর উপর মিথ্যারোপের দৃষ্টান্ত: সাহাবীদের কুৎসা, ইব্রাহীম আ. কে শিরকের অপবাদ দেওয়া, কুরআনের তাফসীরে যা মনে আসে তা লিখে দেওয়া, নবীদের নিষ্পাপ বলে স্বীকার না করা ইত্যাদিসহ তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যারোপ করা হয়েছে। যারা করেছেন তারা সম্ভবত দ্বীনি খেদমত(!) মনে করে করেছেন। প্রশ্ন হলো দ্বীন কি কাউকে ফাঁসানোর স্বার্থেও মিথ্যারোপের অনুমতি দেয়? 
এখানে “মনগড়া” তাফসীর করা নিয়ে দু’কথা বলতে চাচ্ছি। অভিযোগকারীদের আপত্তি হলো মাওলানা মওদুদী তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকাতেই লিখেছেন, “ বরং কুরআন পড়ে আমার যা মনে এসেছে, তাই লিখে দিয়েছি” 
“ 
এই অধমেরও তাফহীমের ভূমিকাটুকু পড়বার সুযোগ হয়েছে। ফলে বুঝতে পারলাম কীভাবে একটা পুরো বাক্যকে কেটে নিজেদের মত সাজিয়ে একাংশ উদ্ধৃত করা হলো। 

তাফহীমুল কুরআনের বৈশিষ্ট্য: (সত্যপন্থীদের মূল কিতাব থেকে পড়ে নেবার জন্য আকুল আবেদন করছি) *তৎপূর্ব তাফসীরগুলো লেখা হয়েছিল শুধু আলেম সমাজের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ করে। ফলে ইসলাম সম্প্রসারিত হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআন বুঝা সহজ ছিলনা। অথচ কুরআন ও হযরত মুহাম্মাদ সা. সমগ্র মানবজাতির জন্যই প্রেরিত (২:১৮৫, ৩৪”২৮ ইত্যাদি) 
*এছাড়া কুরআনের শুধু অনুবাদ বা জটিল তাফসীর পড়লে সাধারণ মানুষ যেমন বোঝেনা তেমনি অমুসলিমরা মর্মার্থ না বুঝে কুরআনের ঘাড়ে দোষ চাপায়। (কেউ অবশ্য বিদ্বেষপ্রসুত হয়েই করে) 

ভুল বোঝার আরেকটা কারণ কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াত নাজিল হয়েছিল নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটকে ঘিরে। তাই কুরআন বুঝতে হলে আয়াতগুলো নাজিলের পেক্ষাপটও বুঝতে হবে। যেমন সুরা তাওবার সেই বিখ্যাত আয়াত-৫, যেটাকে নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, সুরা মু’মিনুনের প্রধম রুকু ইত্যাদি। একমাত্র কারণ প্রেক্ষাপটকে অবহেলা করা। 

*এছাড়া কুরআনের আয়াতগুলো তো নাজিল হয়েছিল ভাষণ আকারে। তাই পথনির্দেশ পেতে হলে এখনও বিভিন্ন ভাষণকে নির্দিষ্ট করে ভাষণকেন্দ্রিকভাবে পড়লে কুরআনের মর্মার্থ সহজেই বুঝে আসবে। 
*কুরআনের অনুবাদ পড়তে আরেকটা অসুবিধা হল শাব্দিক অনুবাদ। বিভিন্ন শব্দের শাব্দিক অনুবাদ করে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হলে যে মূল ভাষার সৌন্দর্য্য ও মর্ম সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যায়না এটা সকলেই জানেন।মূলত অনবাদ করার ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম যে অনুবাদক মূল ভাষা পড়ে যে কথাটা বুঝতে পারলেন অন্য ভাষায় ভাষান্তরের সময় ঠিক সেই কথাটিই সেই ভাষার শব্দ দিয়ে গেঁথে দিতে হবে। এ জন্য যদি প্রতিশব্দকে অবহেলাও করতে হয় তবুও বাক্যের মূল ধারা বজায় রাখবার জন্য উপযুক্ত শব্দই ব্যাবহার করাই বাঞ্চনীয়। 

মাওলানা মওদুদী এটাই করেছেন। শাব্দিক অনুবাদ না করে আরবী কুরআন পড়ে যেটা বুঝতে পারলেন সেটাই অন্য ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।আর এ কথাই বলেছেন। কথাটা হলো- 
”শাব্দিক অনুবাদের এই ত্রুটি ও অভাবগুলো দূর করার জন্য আমি মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাবার্থ প্রকাশের পথ বেছে নিয়েছি। কুরআনের শব্দাবলীকে ভাষান্তরিত করার পরিবর্তে কুরআনের একটি বাক্য পড়ার পর তার যে অর্থ আমার মনে বাসা বেঁধেছে এবং মনের উপর তার যে প্রভাব পড়েছে, তাকে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি।” 
উল্লেখ্য, তিনি কুরআনকে নিজের মত করে সাজিয়ে লেখেননি। কুরআনের অনুবাদকে মানুষের বোঝার মত করে লিখতে সচেষ্ট হয়েছেন। 
যারা শুধু এটা উদ্ধৃত করেন, ”বরং কুরআন পড়ে আমার যা মনে এসেছে, তাই লিখে দিয়েছি” তারা আংশিক উদ্ধৃত করেন কি উদ্দেশ্যে? তারা কি এখানে তাঁকে ফাঁসাতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেননা? 
এরপর মাওলানা মওদুদী আরো লেখেন- “আমার পক্ষ থেকে যতদূর সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব তা করেছি। কুরআন তার বক্তব্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যতটুকু স্বাধীনতা দেয় তার সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করিনি” 
সত্যপন্থী ও নিরপেক্ষ পাঠকদেরকে অনুরোধ করব আপনারা ঐ ভূমিকাটুকু খোলামন নিয়ে বিস্তারিত পড়বেন। এরপর আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন। 

সমালোচনার জবাব দেওয়া কি অন্ধ-অনুসরণের ফল?: 
অভিযোগকারীদের আরেকটি দাবী হলো কোন মহল মওদুদীকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে। এর স্বপক্ষে তাদের যুক্তি হলো যখনই মওদুদীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠে তখনই তারা সেটা খন্ডনে উঠেপড়ে লাগে। আসল কথা হলো কোন মুসলিমের বিরুদ্ধে কোন মিথ্যারোপ করা হলে সেটার যৌক্তিক জবাব দেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। মাওলানা মওদুদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও যদি সেটার আনুগত্য করা হত তবে অন্ধ-অনসরণের কথা তোলা যেত।বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা করে আমি যা পেলাম, মওদুদীর অন্ধ-অনুসরণকারী নয় অন্ধ-বিরোধীর সংখ্যাই প্রচুর। 

মওদুদীর গবেষণা কর্ম সত্যপন্তী মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এ সত্যকে স্বীকৃতি দেওয়া আর অন্ধ অনুসরণ এক কথা নয়। অন্ধ-অনুসরণ হত যদি সঠিক কোন অভিযোগকে স্বীকার না করা হত। যে অভিযোগের ভিত্তি হচ্ছে বিদ্বেষপ্রসূত আংশিক উদ্ধৃতি সেটাকে খন্ডন করার চেষ্টাকে অন্ধ-অনুসরণ মোটেই বলা যায়না। 
ফিকহের ব্যাপারেও তো তিনি অনেক মাসয়ালা দিয়েছেন। জামায়াত কি সেগুলোই অন্ধভাবে মেনে চলে? তাহলে কি করে এ আপত্তি করা যায়? 

মওদুদীর ব্যপারে জামায়াতের মনোভঙ্গি: তাঁর ব্যপারে জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে কোন ব্লগার, বা অন্য কারো কথার উপর নির্ভর করা অনুচিত। আমরা অধ্যাপক গোলাম আযমের কথা থেকে দৃষ্টিভঙ্গিটা পেতে পারি। ইকামাতে দ্বীন গ্রন্থের ৮২ নং পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন- “তাঁর অগণিত পাঠক পাঠিকা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে। যিনি এত কিছু লিখেছেন তাঁর লেখায় কোন ভুল ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। যারা জ্ঞান চর্চায় নিযুক্ত তারা যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে তার লেখার সমালোচনা করলে দ্বীনের অবশ্যই উপকার ও খেদমত হবে” 
অর্থ্যাৎ বস্তুনিষ্ঠ ও যৌক্তিক সমালোচনা করলে জামায়াত তা মেনে নিতে প্রস্তুত। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারো বিরুদ্ধে ব্যক্তি আক্রোশ মেটানো কেমন কাজ? 

অন্ধ-অনুসারী নাকি অন্ধ-বিদ্বেষী? 
পূর্বেই দেখিয়েছি জামায়াত অন্ধ-অনুসারী নয়। বরং বিভিন্ন সময় দেখা গেছে তাঁর বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ অকাট্যভাবে খন্ডন করার পরেও কতক মুসলিম নিজেদের আংশিক-উদ্ধৃতিতেই অটল আছেন। তাহলে কি বুঝা গেল? অন্ধ-অনুসরণ নাকি অন্ধ-বিদ্বেষ? ভুল করে থাকলে তো প্রত্যেক মুসলিমের উচিত ভুলের স্বীকৃতি দেওয়া ও সত্যকে অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নেওয়া। 

তথাকথিত সমালোচকদের ইসলাম-প্রেম: ব্লগে তাদের অনেককেই দেখা যায় নাস্তিক বলে বহুল পরিচিতদের সাথে গলায় গলায় ভাব। নিজেদের পোস্টে নাস্তিকদের মন্তব্য পেয়ে তারা খুশিতে গদগদ হয়ে নাস্তিকদের মোবারকবাদ জানাতে থাকেন। এদেরকে নাস্তিকদের ইসলাম-বিদ্বেষী পোস্টে তেমন কোন অবস্থান নিতেও দেখা যায়না। অতীতেও দেখা গেছে যারা মাওলানার বিদ্বেষপ্রসূত সমালোচনা করেছেন তারা পরবর্তীতে হাদিছ-অস্বীকারকারী ইত্যাদি রূপে পরিচিত হয়েছেন। 
মাওলানা মওদুদী কি তাঁকে অন্ধ-অনুসরণ করতে বলেছেন? 
তিনি ১৯৪১ সালে জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হলে জামায়াতকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন যেন তাঁর কোন কথাকে অন্ধ-অনুসরণ করা বা মাপকাঠি হিসেবে না মানা হয়। 
প্রাসঙ্গিক পোস্ট: ডা. জাকির নায়েক ও মাওলানা মওদুদীর সমালোচনা। পরিণতি কী???? 


0 টি মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন